শ্যামাপ্রসাদ নিয়ে কিছু অপব্যাখ্যার উত্তরে
জনৈক তমাল দাশগুপ্ত শ্যামাপ্রসাদ
সম্বন্ধে কিছু বিশ্লেষণ করেছেন, যা বন্ধুবর এবং হিন্দু সংহতি-খ্যাত তপন ঘোষ আমাকে পাঠিয়েছেন
| বিশ্লেষণ অত্যন্ত অগভীর, তবে একেবারে ফেলে দেবার মত নয় | এ সম্বন্ধে আমার মন্তব্য
নিচে দিলাম | প্রসঙ্গত একা তমাল নয়, এ ধরণের অগভীর আলোচনা আরো দুয়েকজন করেছেন, যাঁদের
মধ্যে উল্লেখযোগ্য জয়া চ্যাটার্জি এবং ক্রিস্টোফার জাফলো |
এই লেখাটা পড়েছেন কি? আপনার উল্লেখ আছে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে এই তমাল দাশগুপ্তের ব্যাপক পড়াশোনার ও বেশ কিছু দৃষ্টিভঙ্গীর খুব গুণগ্রাহী। ওর ব্যক্তিগত জীবনও অনাড়ম্বর। প্রাক্তন কমিউনিস্ট হিসাবে স্ট্রাটেজি-তে বিশ্বাস করে। আরো যে বিষয়টা আমার ভাল লাগে - ও নিজের স্ট্রাটেজি সম্বন্ধে নিজেই সংশয়ে ভোগে। ওর একটা স্ট্রাটেজি হল, বামপন্থী হিন্দুদেরকে ও হিন্দুর শত্রু শিবিরে ঠেলে দিতে চায় না। বাঙালির নামে হিন্দু শিবিরে রাখতে চায়।
তপন।
শ্যামাপ্রসাদ ও ভূতের ভবিষ্যৎ
শ্যামাপ্রসাদ বাংলার ইতিহাসে এক অসামান্য চরিত্র, কিন্তু তাঁর সঠিক মূল্যায়ন হতে পারে না কারন সবসময়েই একদল তার পক্ষে , একদল বিপক্ষে, নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ করার কেউ নেই। শুধুমাত্র তাঁর হিন্দু জাতীয়তাবাদী চরিত্রের জন্য এই সমস্যা, তা মনে হয় না। বঙ্কিম এবং শরত জাতীয়তাবাদী ছিলেন, উপরন্তু সরাসরি মুসলমান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বহুবার বলেছেন, কিন্তু তাঁদের নিয়ে এত সমস্যা হয় না, কারন এঁরা মূলত বিপ্লবী সেন্সিবিলিটি র ধারক ও বাহক ছিলেন, এঁদের লেখা পড়লেই সেটা বোঝা যায়। শ্যামাপ্রসাদ বিপ্লবী ছিলেন না, তিনি মূলত ব্রিটিশের অনুগত ছিলেন, এবং তাঁর মূল্যায়নে এটা একটা বড় সমস্যা। শ্যামাপ্রসাদের মূল্যায়নে বাঙালির কোথাও একটা অবচেতন বাধা জন্মায়, কারন বাঙালি স্বভাব-বিপ্লবী। বঙ্কিম-বিবেকানন্দ-অরবিন্দ-চিত্তরঞ্জন-সুভাষ যে জাতীয়তাবাদের ডিসকোর্স নির্মান করে গেছেন, সেখানে শ্যামাপ্রসাদকে খাপ খাওয়ানো যায় না। শ্যামাপ্রসাদ সেখানে আলাদাই থেকে যান।
শ্যামাপ্রসাদের পিতা স্যার আশুতোষ ছিলেন বাংলার বাঘ। দেশ পত্রিকার এবছরের বইমেলা সংখ্যায় দীপেন্দু চক্রবর্তী লিখেছেন, স্যার আশুতোষ ছিলেন খাঁচায় বন্দী বাংলার বাঘ। ব্রিটিশের খাঁচায় বন্দী।
শ্যামাপ্রসাদও অতি অল্পবয়েসে নিজেই সানন্দে এই খাঁচায় ঢুকেছিলেন। যখন বাঙালি বয়কট করছে, গোলদীঘির গোলামখানায় প্রস্রাব করে (ব্রহ্মবান্ধব এই ভাষাই ব্যবহার করেছিলেন) ব্রিটিশের শাসনতন্ত্রকে চুরমার করে ফেলার প্রতিজ্ঞা করছে, তখন আশুতোষ একমনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে সাজাচ্ছেন, সেখানে প্রথম বাংলা পড়ানোর ব্যবস্থা করছেন (শ্যামাপ্রসাদকে আশুতোষ বাংলা এম এ পড়ান)। আশুতোষ যে ব্রিটিশের কোল্যাবরেটর ছিলেন, শ্যামাপ্রসাদ যে সেই কোল্যাবরেশনের ধারাই অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন হল, আশুতোষ কি ভুল করেছিলেন? শ্যামাপ্রসাদ কি সেই ভুলের ধারা বজায় রেখে আরও বড় ভুল করেছিলেন?
যখন বাংলার কংগ্রেস সুভাষকে গান্ধীর দ্বারা বহিষ্কারের পরে মুণ্ডহীন কবন্ধ, ব্রিটিশের নির্মম দমন পীড়নে বাংলার বিপ্লবী আন্দোলন যখন ছারখার, ব্রিটিশের কৌশলে বাংলার আইনসভায় যখন চিরস্থায়ী মুসলমান আধিপত্যের সৃষ্টি হয়েছে, হিন্দুরা কোনঠাসা, অত্যাচারিত, অপমান বিষে জর্জরিত, এমন সময় ফজলুল হকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শ্যামা-হক মন্ত্রীসভা তৈরি করেন শ্যামাপ্রসাদ। এর ফলে পরবর্তী কালে বাংলার হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে ফজলুল হকের প্রতি এক গোপন ভালবাসা জন্ম নিয়েছে, ফজলুল যে ফজলি আমের মতই মিষ্টি ছিলেন তা প্রমাণ করতে তথাগত রায় তাঁর ইংরেজিতে লেখা শ্যামাপ্রসাদ জীবনীতে বিশেষ বেগ পেয়েছেন। অথচ এই ফজলুলই একবার হুমকি দিয়েছিলেন, যে বিহার বা যুক্তপ্রদেশে বা অন্য কোথাও মুসলমানের ওপরে অত্যাচার হলে তিনি বাংলায় হিন্দু মেরে তার শোধ তুলবেন। হুঁ হুঁ বাবা, বাংলায় মুসলমান সংখ্যাগুরু, বললে হবে? শ্যামাপ্রসাদ নাকি উদার ছিলেন, সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, ফজলুলের সঙ্গে আঁতাত তারই প্রমান, তথাগত বলছেন। ফজলুল অবশ্য যুবা বয়েসে স্যার আশুতোষের কাছে আইন-ব্যবসায় শিক্ষানবিশি করেছিলেন, তাই একটা পারিবারিক সম্পর্ক ছিল শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে, সেটা অবশ্যই এই আঁতাতের কেমিস্ট্রিকে সাহায্য করেছিল। কিন্তু তাই বলে শ্যামাপ্রসাদকে মহৎ দেখাতে গিয়ে তথাগত রায় ফজলুলকেই মহৎ বানিয়ে ছেড়েছেন।
আসলে যা বলছিলাম। নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ না হলে এই হয়। শ্যামাপ্রসাদের রাজনীতি আমরা অল্প কয়েক কথায় এখানে যদি বোঝার চেষ্টা করি, তাহলে দেখব, ওরা বাপ-ব্যাটায় একটাই চেষ্টা করেছেন, তা হল, অন্য শক্তিশালী পক্ষকে (সেটা ব্রিটিশ হতে পারে, বা মুসলিম লিগ হতে পারে) না চটিয়েই বাঙালির যথাসম্ভব স্বার্থরক্ষা। এবং একটা কথা আজ স্বীকার করা প্রয়োজন। বাঙালি বহুদিন হল ক্ষমতার রসায়নের পাঠ বন্ধ করে দিয়েছে, কত ধানে কত চাল হয়, তা জানার প্রয়োজন সে মোটেই বোধ করে নি। তাই দেখি রাসবিহারি যখন দিল্লিতে এসে ভাইসরয়ের ওপরে বোমা মেরে যাচ্ছেন, তখন পাঞ্জাবি কন্ট্র্যাক্টরেরা নতুন দিল্লি বানানোর ব্যবসায় নেমে লাল হয়ে যাচ্ছে। আজ বাঙালি প্রায় ভিখিরি, পাঞ্জাবি লাল থেকে লালতর হয়েছে ইতিমধ্যে। ওই এক ভগত সিং বা গদর পার্টি দেখে ভুলবেন না। বেশিরভাগ পাঞ্জাবিই ব্রিটিশের অনুগত দালাল থেকে গেছিল, বাঙালিদের মত দলে দলে বোমাপিস্তল হাতে ব্রিটিশ মারতে নেমে পড়েনি।
প্রশ্ন হল এইঃ একটা জাতির লোকে ভারতের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিল, আন্দামান জেল ভরে গেল বাঙালিতে, আর তাদেরই শহর কলকাতা তুলে দেওয়া হল মাড়োয়াড়ি ব্যবসায়ীদের হাতে। এজন্যই হয়ত দেওয়া হল। বাংলাজুড়ে মুসলিম লিগের পেটোয়া গুণ্ডাদের লেলিয়ে দেওয়া হল তাদের বিরুদ্ধে, স্বভূমিতে তারা পরবাসী হয়ে গেল, পূর্ববঙ্গ ছেড়ে পালিয়ে এল তারা, সেই পলায়ন আজও চলছে। বাঙালি বিপ্লবীদের মগজধোলাই করে ব্রিটিশের জেলের মধ্যে আন্তর্জাতিকতাবাদী বানানো হল, পিস্তল কেড়ে নিয়ে ডাস ক্যাপিট্যাল ধরিয়ে দেওয়া হল। বাঙালিকে সেখানো হল, জাতীয়তাবাদ খুব খারাপ একটা ব্যাপার। কবচ-কুণ্ডল ত্যাগ কর, নইলে তোমায় মারব কিভাবে? হয় বিশ্বমানব হও, নয়ত বিশ্ববিপ্লবী হও, নইলে তোমায় পাঁঠাবলি করব কি ভাবে?
বাঙালি কি বোঝেনি, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে এইভাবে দাঁড়ালে ব্রিটিশ ছেড়ে দেবে না? এই জাতিকে ধ্বংস করার জন্য সমস্ত প্রয়াস ব্রিটিশ নেবেই? বাঙালি কি বোঝেনি যে তার আটশো বছরের শত্রু মুসলমান তাকে হারিয়েই এই দেশ ছিনিয়ে নিয়েছিল তার কাছ থেকে, এবং যতক্ষণ না পর্যন্ত আবার তাকে হারিয়ে দিয়ে এই দেশের পূর্ণ অধিকার আবার সে ছিনিয়ে নিচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত মুসলমান শান্তি পাবে না?
বাঙালির শত্রু অনেক। ভারতে সমাজবিপ্লবের, স্বাধীনতার সমস্ত গুরুভার কাঁধে নিয়ে, নীতিজ্ঞান দেখানো হল বটে। কিন্তু কাণ্ডজ্ঞান খুব একটা দেখানো হল কি?
এই প্রেক্ষিতে শ্যামাপ্রসাদকে বিবেচনা করতে হবে। ব্রিটিশের অনুগত থেকেছেন, কিন্তু বাঙালির স্বার্থরক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন। বিশ্বমানব হননি। ট্রান্সফার অভ পাওয়ার (সেটাকে আমরা স্বাধীনতা বলে নাচানাচি করি) যখন একটি ব্রিটিশ অনুগত ক্যাবিনেট তৈরি করছে ভারতে, তখন নেহরু-প্যাটেল-গান্ধী শ্যামাপ্রসাদকে সাদরে ডেকে নিচ্ছেন, এই জেনে যে শ্যামাপ্রসাদও তাদের মতই ব্রিটিশের কাছের লোক। কিন্তু যখন বাঙালির চূড়ান্ত সর্বনাশের প্ল্যান চলছে, নেহরু-লিয়াকত চুক্তির বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে রুখে দাঁড়িয়েছেন শ্যামাপ্রসাদ। যখন মন্ত্রী ছিলেন, বাঙালিকে চাকরি দিয়েছেন দুহাতভরে, স্বজনপোষণ করার দরকার হয়নি সেজন্য। নেহরু যখন চিঠি দিয়ে শাসিয়েছেন, এত বাঙালিকে কেন চাকরি দিচ্ছ, শ্যামাপ্রসাদ জবাব দিচ্ছেন, যোগ্য বলেই চাকরি দিচ্ছি।
শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর পরপরেই কমিউনিস্টদের সেই বিখ্যাত ট্রাম পোড়ানোর আন্দোলন। তার মৃতদেহ তখন কলকাতায় আসছে কাশ্মীর থেকে। এক পয়সা ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে সেদিন কমিউনিস্টরা কলকাতা জুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে বোঝালেন, আগামী দিনের বাংলা তাদের কব্জায় থাকতে চলেছে। ১৯৫৩ সাল যেন একটা ওয়াটারশেড, বা ইতিহাস-বিভাজিকা।
এও বলা দরকার যে বাঙালির মধ্যে কমিউনিস্টদের সাফল্যের কারন তারা বাংলার বিপ্লবী ঐতিহ্যকে আত্মসাৎ করতে পেরেছে। শ্যামাপ্রসাদ বিপ্লবী ছিলেন না, মূলত ব্রিটিশেরই অনুগত ছিলেন, এটা শ্যামাপ্রসাদকে বিশ্লেষণ করার সময় ভুলে থাকলে শ্যামাপ্রসাদকে বুঝতে পারব না আমরা। দুঃখের হলেও সত্যি যে এই কারনেই শ্যামাপ্রসাদ বাঙালিকে খুব বেশি মোটিভেট করতে পারবেন না কোনওদিন।
পশ্চিমবঙ্গ আজও যে হিন্দুর বাসভূমি, তার জন্য শ্যামাপ্রসাদের কিছু অবদান আছে, কিন্তু সেই সময়ে হিন্দুদের মধ্যে বাংলাভাগের পক্ষে এক শরত বসু ছাড়া আর সবাই মত দিয়েছিলেন। অমৃতবাজার পত্রিকার এক সমীক্ষা অনুযায়ী প্রায় একশো শতাংশ শিক্ষিত বাঙালিই চাইছিলেন পশ্চিমবঙ্গ আলাদা থাকুক। মুসলমান সংখ্যাগুরুত্বের গুরুভার নিয়ে বাঁচা সম্ভব নয় সেটা সবাই বুঝতে পারছিলেন। কাজেই এটা অতিশয়োক্তি যে একা হাতে শ্যামাপ্রসাদ বাংলার হিন্দুর বাসভূমি গড়ে দিয়ে গেছেন, এবং এই অতিশয়োক্তির ওপরে শ্যামাপ্রসাদের মূল্যায়ন দাঁড় করালে তাঁর প্রতি অবিচারই করা হবে, কারণ সেই মূল্যায়ন শক্তপোক্ত হবে না।
শ্যামাপ্রসাদ নেহরু লিয়াকত চুক্তির প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট থেকে পদত্যাগ করেছিলেন, তা অবশ্যই তাঁর সাহসী পদক্ষেপ, তা প্রমান করে যে তিনি বাঙালি স্বার্থ নিয়ে আপোস করতে চাননি। কিন্তু বাংলায় আসা উদবাস্তুদের মধ্যে কাজ মোটেই করেনি শ্যামাপ্রসাদের তৈরি, আর এস এস এর আশীর্বাদধন্য জনসঙ্ঘ। এই জায়গাতে কমিউনিস্টরা পুরোপুরি ঢুকে গেছিল। দিল্লিতে পাঞ্জাবি উদবাস্তুদের মধ্যে জনসঙ্ঘ যে কারনে সফল, একই কারনে বাঙালি উদবাস্তুদের ভোটে একচেটিয়া অধিকার কায়েম করেছিল কমিউনিস্টরা, এমনকি মরিচঝাঁপির পরেও তাতে খুব বেশি ভাঁটা পড়েনি।
আর এস এস ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়েনি। নেহরুর বিরুদ্ধেও নয়। শ্যামাপ্রসাদকে মেরে ফেলা হল কাশ্মীরের জেলের মধ্যে, আর এস এস কোনও আন্দোলন করল না। কিন্তু এর একটা সুফল হল এই যে আর এস এস টিকে গেছে, যেখানে অন্যান্য জাতীয়তাবাদী শক্তি নির্মম দমন পীড়নের শিকার হয়ে শেষমেশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হল।
আজ যে প্রশ্নের উত্তর না খুঁজলেই নয়, তা হল, সুভাষের বিপ্লবী পথ ও শ্যামাপ্রসাদের মডারেট পথ, এ দুটোর মধ্যে কোনটা ঠিক পথ? কোনটা ভুল পথ? দুটোই কি ঠিক? দুটোই কি ভুল? বাঙালির ভবিষ্যত নির্ভর করছে এই প্রশ্নের উত্তরের ওপরে।
থুড়ি। বাঙালি তো মরে ভূত হয়ে গেছে কবেই। তবে ভূতেরও তো একটা ভবিষ্যৎ থাকতে পারে। এই ভূতেরই ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই প্রশ্নের উত্তরের ওপরে, বাংলার ইতিহাসে শ্যামাপ্রসাদের অবস্থানের একটা বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ ছাড়া যে উত্তর সম্ভবই নয়।
শ্যামাপ্রসাদ বাংলার ইতিহাসে এক অসামান্য চরিত্র, কিন্তু তাঁর সঠিক মূল্যায়ন হতে পারে না কারন সবসময়েই একদল তার পক্ষে , একদল বিপক্ষে, নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ করার কেউ নেই। শুধুমাত্র তাঁর হিন্দু জাতীয়তাবাদী চরিত্রের জন্য এই সমস্যা, তা মনে হয় না। বঙ্কিম এবং শরত জাতীয়তাবাদী ছিলেন, উপরন্তু সরাসরি মুসলমান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বহুবার বলেছেন, কিন্তু তাঁদের নিয়ে এত সমস্যা হয় না, কারন এঁরা মূলত বিপ্লবী সেন্সিবিলিটি র ধারক ও বাহক ছিলেন, এঁদের লেখা পড়লেই সেটা বোঝা যায়। শ্যামাপ্রসাদ বিপ্লবী ছিলেন না, তিনি মূলত ব্রিটিশের অনুগত ছিলেন, এবং তাঁর মূল্যায়নে এটা একটা বড় সমস্যা। শ্যামাপ্রসাদের মূল্যায়নে বাঙালির কোথাও একটা অবচেতন বাধা জন্মায়, কারন বাঙালি স্বভাব-বিপ্লবী। বঙ্কিম-বিবেকানন্দ-অরবিন্দ-চিত্তরঞ্জন-সুভাষ যে জাতীয়তাবাদের ডিসকোর্স নির্মান করে গেছেন, সেখানে শ্যামাপ্রসাদকে খাপ খাওয়ানো যায় না। শ্যামাপ্রসাদ সেখানে আলাদাই থেকে যান।
শ্যামাপ্রসাদের পিতা স্যার আশুতোষ ছিলেন বাংলার বাঘ। দেশ পত্রিকার এবছরের বইমেলা সংখ্যায় দীপেন্দু চক্রবর্তী লিখেছেন, স্যার আশুতোষ ছিলেন খাঁচায় বন্দী বাংলার বাঘ। ব্রিটিশের খাঁচায় বন্দী।
শ্যামাপ্রসাদও অতি অল্পবয়েসে নিজেই সানন্দে এই খাঁচায় ঢুকেছিলেন। যখন বাঙালি বয়কট করছে, গোলদীঘির গোলামখানায় প্রস্রাব করে (ব্রহ্মবান্ধব এই ভাষাই ব্যবহার করেছিলেন) ব্রিটিশের শাসনতন্ত্রকে চুরমার করে ফেলার প্রতিজ্ঞা করছে, তখন আশুতোষ একমনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে সাজাচ্ছেন, সেখানে প্রথম বাংলা পড়ানোর ব্যবস্থা করছেন (শ্যামাপ্রসাদকে আশুতোষ বাংলা এম এ পড়ান)। আশুতোষ যে ব্রিটিশের কোল্যাবরেটর ছিলেন, শ্যামাপ্রসাদ যে সেই কোল্যাবরেশনের ধারাই অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন হল, আশুতোষ কি ভুল করেছিলেন? শ্যামাপ্রসাদ কি সেই ভুলের ধারা বজায় রেখে আরও বড় ভুল করেছিলেন?
যখন বাংলার কংগ্রেস সুভাষকে গান্ধীর দ্বারা বহিষ্কারের পরে মুণ্ডহীন কবন্ধ, ব্রিটিশের নির্মম দমন পীড়নে বাংলার বিপ্লবী আন্দোলন যখন ছারখার, ব্রিটিশের কৌশলে বাংলার আইনসভায় যখন চিরস্থায়ী মুসলমান আধিপত্যের সৃষ্টি হয়েছে, হিন্দুরা কোনঠাসা, অত্যাচারিত, অপমান বিষে জর্জরিত, এমন সময় ফজলুল হকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শ্যামা-হক মন্ত্রীসভা তৈরি করেন শ্যামাপ্রসাদ। এর ফলে পরবর্তী কালে বাংলার হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে ফজলুল হকের প্রতি এক গোপন ভালবাসা জন্ম নিয়েছে, ফজলুল যে ফজলি আমের মতই মিষ্টি ছিলেন তা প্রমাণ করতে তথাগত রায় তাঁর ইংরেজিতে লেখা শ্যামাপ্রসাদ জীবনীতে বিশেষ বেগ পেয়েছেন। অথচ এই ফজলুলই একবার হুমকি দিয়েছিলেন, যে বিহার বা যুক্তপ্রদেশে বা অন্য কোথাও মুসলমানের ওপরে অত্যাচার হলে তিনি বাংলায় হিন্দু মেরে তার শোধ তুলবেন। হুঁ হুঁ বাবা, বাংলায় মুসলমান সংখ্যাগুরু, বললে হবে? শ্যামাপ্রসাদ নাকি উদার ছিলেন, সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, ফজলুলের সঙ্গে আঁতাত তারই প্রমান, তথাগত বলছেন। ফজলুল অবশ্য যুবা বয়েসে স্যার আশুতোষের কাছে আইন-ব্যবসায় শিক্ষানবিশি করেছিলেন, তাই একটা পারিবারিক সম্পর্ক ছিল শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে, সেটা অবশ্যই এই আঁতাতের কেমিস্ট্রিকে সাহায্য করেছিল। কিন্তু তাই বলে শ্যামাপ্রসাদকে মহৎ দেখাতে গিয়ে তথাগত রায় ফজলুলকেই মহৎ বানিয়ে ছেড়েছেন।
আসলে যা বলছিলাম। নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ না হলে এই হয়। শ্যামাপ্রসাদের রাজনীতি আমরা অল্প কয়েক কথায় এখানে যদি বোঝার চেষ্টা করি, তাহলে দেখব, ওরা বাপ-ব্যাটায় একটাই চেষ্টা করেছেন, তা হল, অন্য শক্তিশালী পক্ষকে (সেটা ব্রিটিশ হতে পারে, বা মুসলিম লিগ হতে পারে) না চটিয়েই বাঙালির যথাসম্ভব স্বার্থরক্ষা। এবং একটা কথা আজ স্বীকার করা প্রয়োজন। বাঙালি বহুদিন হল ক্ষমতার রসায়নের পাঠ বন্ধ করে দিয়েছে, কত ধানে কত চাল হয়, তা জানার প্রয়োজন সে মোটেই বোধ করে নি। তাই দেখি রাসবিহারি যখন দিল্লিতে এসে ভাইসরয়ের ওপরে বোমা মেরে যাচ্ছেন, তখন পাঞ্জাবি কন্ট্র্যাক্টরেরা নতুন দিল্লি বানানোর ব্যবসায় নেমে লাল হয়ে যাচ্ছে। আজ বাঙালি প্রায় ভিখিরি, পাঞ্জাবি লাল থেকে লালতর হয়েছে ইতিমধ্যে। ওই এক ভগত সিং বা গদর পার্টি দেখে ভুলবেন না। বেশিরভাগ পাঞ্জাবিই ব্রিটিশের অনুগত দালাল থেকে গেছিল, বাঙালিদের মত দলে দলে বোমাপিস্তল হাতে ব্রিটিশ মারতে নেমে পড়েনি।
প্রশ্ন হল এইঃ একটা জাতির লোকে ভারতের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিল, আন্দামান জেল ভরে গেল বাঙালিতে, আর তাদেরই শহর কলকাতা তুলে দেওয়া হল মাড়োয়াড়ি ব্যবসায়ীদের হাতে। এজন্যই হয়ত দেওয়া হল। বাংলাজুড়ে মুসলিম লিগের পেটোয়া গুণ্ডাদের লেলিয়ে দেওয়া হল তাদের বিরুদ্ধে, স্বভূমিতে তারা পরবাসী হয়ে গেল, পূর্ববঙ্গ ছেড়ে পালিয়ে এল তারা, সেই পলায়ন আজও চলছে। বাঙালি বিপ্লবীদের মগজধোলাই করে ব্রিটিশের জেলের মধ্যে আন্তর্জাতিকতাবাদী বানানো হল, পিস্তল কেড়ে নিয়ে ডাস ক্যাপিট্যাল ধরিয়ে দেওয়া হল। বাঙালিকে সেখানো হল, জাতীয়তাবাদ খুব খারাপ একটা ব্যাপার। কবচ-কুণ্ডল ত্যাগ কর, নইলে তোমায় মারব কিভাবে? হয় বিশ্বমানব হও, নয়ত বিশ্ববিপ্লবী হও, নইলে তোমায় পাঁঠাবলি করব কি ভাবে?
বাঙালি কি বোঝেনি, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে এইভাবে দাঁড়ালে ব্রিটিশ ছেড়ে দেবে না? এই জাতিকে ধ্বংস করার জন্য সমস্ত প্রয়াস ব্রিটিশ নেবেই? বাঙালি কি বোঝেনি যে তার আটশো বছরের শত্রু মুসলমান তাকে হারিয়েই এই দেশ ছিনিয়ে নিয়েছিল তার কাছ থেকে, এবং যতক্ষণ না পর্যন্ত আবার তাকে হারিয়ে দিয়ে এই দেশের পূর্ণ অধিকার আবার সে ছিনিয়ে নিচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত মুসলমান শান্তি পাবে না?
বাঙালির শত্রু অনেক। ভারতে সমাজবিপ্লবের, স্বাধীনতার সমস্ত গুরুভার কাঁধে নিয়ে, নীতিজ্ঞান দেখানো হল বটে। কিন্তু কাণ্ডজ্ঞান খুব একটা দেখানো হল কি?
এই প্রেক্ষিতে শ্যামাপ্রসাদকে বিবেচনা করতে হবে। ব্রিটিশের অনুগত থেকেছেন, কিন্তু বাঙালির স্বার্থরক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন। বিশ্বমানব হননি। ট্রান্সফার অভ পাওয়ার (সেটাকে আমরা স্বাধীনতা বলে নাচানাচি করি) যখন একটি ব্রিটিশ অনুগত ক্যাবিনেট তৈরি করছে ভারতে, তখন নেহরু-প্যাটেল-গান্ধী শ্যামাপ্রসাদকে সাদরে ডেকে নিচ্ছেন, এই জেনে যে শ্যামাপ্রসাদও তাদের মতই ব্রিটিশের কাছের লোক। কিন্তু যখন বাঙালির চূড়ান্ত সর্বনাশের প্ল্যান চলছে, নেহরু-লিয়াকত চুক্তির বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে রুখে দাঁড়িয়েছেন শ্যামাপ্রসাদ। যখন মন্ত্রী ছিলেন, বাঙালিকে চাকরি দিয়েছেন দুহাতভরে, স্বজনপোষণ করার দরকার হয়নি সেজন্য। নেহরু যখন চিঠি দিয়ে শাসিয়েছেন, এত বাঙালিকে কেন চাকরি দিচ্ছ, শ্যামাপ্রসাদ জবাব দিচ্ছেন, যোগ্য বলেই চাকরি দিচ্ছি।
শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর পরপরেই কমিউনিস্টদের সেই বিখ্যাত ট্রাম পোড়ানোর আন্দোলন। তার মৃতদেহ তখন কলকাতায় আসছে কাশ্মীর থেকে। এক পয়সা ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে সেদিন কমিউনিস্টরা কলকাতা জুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে বোঝালেন, আগামী দিনের বাংলা তাদের কব্জায় থাকতে চলেছে। ১৯৫৩ সাল যেন একটা ওয়াটারশেড, বা ইতিহাস-বিভাজিকা।
এও বলা দরকার যে বাঙালির মধ্যে কমিউনিস্টদের সাফল্যের কারন তারা বাংলার বিপ্লবী ঐতিহ্যকে আত্মসাৎ করতে পেরেছে। শ্যামাপ্রসাদ বিপ্লবী ছিলেন না, মূলত ব্রিটিশেরই অনুগত ছিলেন, এটা শ্যামাপ্রসাদকে বিশ্লেষণ করার সময় ভুলে থাকলে শ্যামাপ্রসাদকে বুঝতে পারব না আমরা। দুঃখের হলেও সত্যি যে এই কারনেই শ্যামাপ্রসাদ বাঙালিকে খুব বেশি মোটিভেট করতে পারবেন না কোনওদিন।
পশ্চিমবঙ্গ আজও যে হিন্দুর বাসভূমি, তার জন্য শ্যামাপ্রসাদের কিছু অবদান আছে, কিন্তু সেই সময়ে হিন্দুদের মধ্যে বাংলাভাগের পক্ষে এক শরত বসু ছাড়া আর সবাই মত দিয়েছিলেন। অমৃতবাজার পত্রিকার এক সমীক্ষা অনুযায়ী প্রায় একশো শতাংশ শিক্ষিত বাঙালিই চাইছিলেন পশ্চিমবঙ্গ আলাদা থাকুক। মুসলমান সংখ্যাগুরুত্বের গুরুভার নিয়ে বাঁচা সম্ভব নয় সেটা সবাই বুঝতে পারছিলেন। কাজেই এটা অতিশয়োক্তি যে একা হাতে শ্যামাপ্রসাদ বাংলার হিন্দুর বাসভূমি গড়ে দিয়ে গেছেন, এবং এই অতিশয়োক্তির ওপরে শ্যামাপ্রসাদের মূল্যায়ন দাঁড় করালে তাঁর প্রতি অবিচারই করা হবে, কারণ সেই মূল্যায়ন শক্তপোক্ত হবে না।
শ্যামাপ্রসাদ নেহরু লিয়াকত চুক্তির প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট থেকে পদত্যাগ করেছিলেন, তা অবশ্যই তাঁর সাহসী পদক্ষেপ, তা প্রমান করে যে তিনি বাঙালি স্বার্থ নিয়ে আপোস করতে চাননি। কিন্তু বাংলায় আসা উদবাস্তুদের মধ্যে কাজ মোটেই করেনি শ্যামাপ্রসাদের তৈরি, আর এস এস এর আশীর্বাদধন্য জনসঙ্ঘ। এই জায়গাতে কমিউনিস্টরা পুরোপুরি ঢুকে গেছিল। দিল্লিতে পাঞ্জাবি উদবাস্তুদের মধ্যে জনসঙ্ঘ যে কারনে সফল, একই কারনে বাঙালি উদবাস্তুদের ভোটে একচেটিয়া অধিকার কায়েম করেছিল কমিউনিস্টরা, এমনকি মরিচঝাঁপির পরেও তাতে খুব বেশি ভাঁটা পড়েনি।
আর এস এস ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়েনি। নেহরুর বিরুদ্ধেও নয়। শ্যামাপ্রসাদকে মেরে ফেলা হল কাশ্মীরের জেলের মধ্যে, আর এস এস কোনও আন্দোলন করল না। কিন্তু এর একটা সুফল হল এই যে আর এস এস টিকে গেছে, যেখানে অন্যান্য জাতীয়তাবাদী শক্তি নির্মম দমন পীড়নের শিকার হয়ে শেষমেশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হল।
আজ যে প্রশ্নের উত্তর না খুঁজলেই নয়, তা হল, সুভাষের বিপ্লবী পথ ও শ্যামাপ্রসাদের মডারেট পথ, এ দুটোর মধ্যে কোনটা ঠিক পথ? কোনটা ভুল পথ? দুটোই কি ঠিক? দুটোই কি ভুল? বাঙালির ভবিষ্যত নির্ভর করছে এই প্রশ্নের উত্তরের ওপরে।
থুড়ি। বাঙালি তো মরে ভূত হয়ে গেছে কবেই। তবে ভূতেরও তো একটা ভবিষ্যৎ থাকতে পারে। এই ভূতেরই ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই প্রশ্নের উত্তরের ওপরে, বাংলার ইতিহাসে শ্যামাপ্রসাদের অবস্থানের একটা বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ ছাড়া যে উত্তর সম্ভবই নয়।
মন্তব্য - তথাগত রায়
তমাল দাশগুপ্তের বক্তব্য মন দিয়ে পড়া গেল | দুঃখের বিষয়, মনে হচ্ছে উনি আমার বইটা তেমন মন দিয়ে পড়েন নি | যাই হোক, কিছু মন্তব্য নীচে দিলাম |
প্রথমত, গোড়ায় গলদ | তমাল যাদের বাঙালি বলে নিজের বক্তব্য রেখেছেন তাদের 'বাঙালি' বলা অর্ধ সত্য মাত্র | তাদের পূর্ণ পরিচয় বাঙালি-হিন্দু | বাংলা যাদের মাতৃভাষা তাদের যদি 'বাঙালি' ধরা হয় তবে বাঙালিদের মধ্যে বাঙালি-হিন্দু নেহাতই সংখ্যালঘু | খুব মোটা হিসেবে আজকের পৃথিবীতে চব্বিশ কোটি বাংলাভাষী আছে, তার মধ্যে মাত্র সাত কোটি বাঙালি-হিন্দু , সতেরো কোটি বাঙালি-মুসলমান | এই দুই সম্প্রদায়ের ধর্ম আলাদা তো বটেই, তাছাড়া সমাজ এক নয়, রাজনীতি এক নয়, এমন কি ভাষা পর্যন্ত পুরোপুরি এক নয় | তমাল এই প্রভেদটা পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারেন নি বলেই মনে হয় | ফলে বিশ্লেষণটি কাঁচা থেকে গেছে |
তমালের বক্তব্য থেকে অংশ তুলে তার সম্বন্ধে মন্তব্য |
সবসময়েই একদল তার পক্ষে , একদল বিপক্ষে, নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ করার কেউ নেই।
নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ না হলে এই হয়।
কোনো সাম্প্রতিক চরিত্র, বিশেষ করে তিনি যদি রাজনৈতিক চরিত্র হন, এবং আরো বিশেষ করে নিজের দেশের, সম্বন্ধে ‘নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ’ আশা করা বাতুলতা | যিনি বিশ্লেষণ করবেন তার কোনো রাজনৈতিক মত থাকবে না এটা অসম্ভব, এবং সেই মতের ছাপ বিশ্লেষণে পড়বেই | তমালের নিজের ছাপও পড়েছে, পার্টি ছেড়েছেন কিন্তু বামপন্থী পলিটিকাল ইডিয়ম ছাড়তে পারেন নি, দেশের স্বাধীনতাকে ট্রান্সফার অফ পাওয়ার (“এ আজাদী ঝুটা হায়” স্মর্তব্য) বলে ব্যঙ্গ করার চেষ্টা করেছেন
| সম্রাট
অশোক বা বিক্রমাদিত্য, এব্রাহাম লিঙ্কন বা উইনস্টন
চার্চিল সম্বন্ধে নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ হলেও হতে পারে -- তাও খুব সহজে নয় | কিন্তু কোনো ভারতীয় বা পাকিস্তানী বিশ্লেষকের পক্ষে আওরংজেব বা শিবাজী, জিন্না বা জওহরলাল সম্বন্ধে ‘নৈর্ব্যক্তিক
বিশ্লেষণ’ একেবারেই অসম্ভব |
শ্যামাপ্রসাদ
বিপ্লবী
ছিলেন
না,
তিনি
মূলত
ব্রিটিশের
অনুগত
ছিলেন|
প্রথম কথাটি খাঁটি সত্য, দ্বিতীয়টি অর্থহীন এবং অসত্যও বটে | শ্যামাপ্রসাদ যতদিন শিক্ষার জগতে ছিলেন ততদিন ব্রিটিশ-বিরোধিতার প্রশ্নই ওঠে না | রাজনীতিতে এসেছেন ১৯৩৯-এ, দেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৭-এ (আজ্ঞে হ্যাঁ, স্বাধীন, এ আজাদী ঝুটা নয়) | এই আট বছরের মধ্যে ব্রিটিশের বিরোধিতার মাঝেই হিন্দু মহাসভায় নেতৃত্ব দিয়েছেন, ব্রিটিশ গভর্ণর হার্বার্ট-এর প্রতিবাদ করে মন্ত্রিসভা ছেড়েছেন, ৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময় অসাধারণ জনসেবা করেছেন, মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভাকে আইনসভায় বিদ্রুপে বিদ্ধ করেছেন (আর কিছু করার ছিল না) | এই সময় কংগ্রেস এক রাজনৈতিক হঠকারিতা করে সমস্ত রাজ্যের শাসনভার ছেড়ে দিয়েছিল, তারপর আর এক হঠকারিতা করে সবাই মিলে জেলে ঢুকেছিল | মুসলিম লীগ ওয়াক-ওভার পেয়ে দেশে নিজেদের সমর্থন তৈরী করেছিল | কোন পথটা ঠিক?
বাঙালি
স্বভাব-বিপ্লবী।
বঙ্কিম-বিবেকানন্দ-অরবিন্দ-চিত্তরঞ্জন-সুভাষ
যে
জাতীয়তাবাদের
ডিসকোর্স
নির্মান
করে
গেছেন,
সেখানে
শ্যামাপ্রসাদকে
খাপ
খাওয়ানো
যায়
না।
আবার সেই 'গোড়ায় গলদ', বাঙালি এবং বাঙালি-হিন্দু গুলিয়ে ফেলা | বাঙালির বৃহদংশ, বাঙালি-মুসলমান আদৌ বিপ্লবী নয় | বিংশ শতাব্দীর আগে বাঙালি-হিন্দুরও কোনো বিপ্লবীপনার প্রমান পাওয়া যায় না | বিংশ শতাব্দীর গোড়ার থেকে ত্রিশের দশকের শেষ পর্যন্ত যে বিপ্লব আমরা বাঙালি-হিন্দুর মধ্যে দেখেছি তা প্রধানত দক্ষিণ বাংলার একটি অঞ্চলে সীমাবদ্ধ -- পূর্ববাংলার কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, ঢাকা, বরিশাল, ত্রিপুরা ও চট্টগ্রাম এবং পশ্চিমবাংলার মেদিনীপুর | বাকি বাঙালি-হিন্দুর বিপ্লব ছিল ''উত্তেজনার আগুন-পোহানো" |
আজকে বাঙালি-হিন্দুর যে ‘বিপ্লবী’ পরিচয় আছে তা হল বন্ধ-অবরোধ-ঘেরাও-মিছিল-চলবে না-দিতে হবে মানতে হবে ইত্যাদিকে, বেসিক্যালি ফাঁকিবাজি এবং
বিশৃঙ্খলাকে,
একটা মার্ক্সবাদী মোড়কে পুরে ভদ্রীকৃত করে তৈরী একটা বামপন্থীদের বানানো ভ্যালু সিস্টেম | এটি বামপন্থীরা বানাতে পড়েছিল, কারণ উনিশশো ত্রিশের দশকের পর থেকে বাংলার বৌদ্ধিক জগতে তাদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না | বর্তমান ভারতে বাঙালির যে বদনাম, এবং বাঙালিদের নিয়ে যে সবাই হাসাহাসি করে তার মূল কারণ এই বিচিত্র বাঙালি-হিন্দু বিপ্লবীপনা | এর কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো |
বঙ্কিম-বিবেকানন্দ-অরবিন্দ-চিত্তরঞ্জন-সুভাষ একসাথে ব্রাকেট
করার যুক্তি বোধগম্য হল না, ডিসকোর্স-এর প্রশ্নই ওঠে না | বঙ্কিম কিছু লেখার মাধ্যমে
বাঙালি-হিন্দু জাতীয়তাবাদের একটা অস্পষ্ট কাঠামো খাড়া করে দিয়েছিলেন | বিবেকানন্দ হিন্দুত্বের,
বিশেষত বেদান্তের মহত্ব প্রচার করেছেন, অসাধারণ একটি প্রতিষ্ঠান তৈরী করেছেন, মানুষকে
শিবজ্ঞানে জীবসেবা করতে শিখিয়েছেন | রাজনীতির ধারই মাড়ান নি - এর মধ্যে জাতীয়তাবাদের প্রশ্ন আসে কোথা
থেকে? অরবিন্দের রাজনীতি কোনোরকম দানা বাঁধবার আগেই তো উনি রাজনীতি ছেড়েই দিলেন ! চিত্তরঞ্জন-সুভাষ
পুরোদস্তুর রাজনীতির মানুষ, কিন্তু তাদের মধ্যে কমনালিটি কি? চিত্তরঞ্জন বেঙ্গল প্যাক্ট-এর মধ্যে দিয়ে বাঙালি-হিন্দু
ও বাঙালি-মুসলমানকে মেলাবার চেষ্টা করেছিলেন, সশস্ত্র সংগ্রামের কথা তাঁর কল্পনাতেও
ছিল না | সুভাষ সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ভারতকে স্বাধীন করার চেষ্টা করেছিলেন,
সেজন্য হিটলারকে ধরতেও পিছপা হন নি|
আশুতোষ
যে
ব্রিটিশের
কোল্যাবরেটর
ছিলেন,
শ্যামাপ্রসাদ
যে
সেই
কোল্যাবরেশনের
ধারাই
অক্ষুণ্ণ
রেখেছিলেন,
তা
নিয়ে
প্রশ্ন
নেই।
বিলক্ষণ প্রশ্ন আছে | হাস্যকর যুক্তি | ব্রিটিশের কোলাবোরেটার হবার প্রশ্ন আসে যখন মানুষ রাজনীতি করে | আশুতোষ রাজনীতি করতেন না, শিক্ষাব্রতী ছিলেন | কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে আশুতোষ একটা অসাধারণ জায়গায় নিয়ে তুলেছিলেন, সেখানে সি ভি রামন, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, স্টেলা ক্রামরিশ, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এনে বসিয়েছিলেন | সেই ট্র্যাডিশন ১৯৩৯ পর্যন্ত শ্যামাপ্রসাদও অনুসরণ করেছিলেন |
রবীন্দ্রনাথ যখন বিশ্বভারতী তৈরী করছিলেন, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র যখন বেঙ্গল কেমিক্যাল তৈরী করছিলেন তখন কি তাঁরা কোলাবোরেশন করছিলেন ? কিন্তু তমালের নালিশ, এঁরা কেন এর পাশাপাশি মেঠো বকতৃতা করে লোক খেপান নি?
ফজলুল
হকের
প্রতি
এক
গোপন
ভালবাসা
জন্ম
নিয়েছে,
ফজলুল
যে
ফজলি
আমের
মতই
মিষ্টি
ছিলেন
তা
প্রমাণ
করতে
তথাগত
রায়
তাঁর
ইংরেজিতে
লেখা
শ্যামাপ্রসাদ
জীবনীতে
বিশেষ
বেগ
পেয়েছেন।
অথচ
এই
ফজলুলই
একবার
হুমকি
দিয়েছিলেন,
যে
বিহার
বা
যুক্তপ্রদেশে
বা
অন্য
কোথাও
মুসলমানের
ওপরে
অত্যাচার
হলে
তিনি
বাংলায়
হিন্দু
মেরে
তার
শোধ
তুলবেন। হুঁ হুঁ
বাবা,
বাংলায়
মুসলমান
সংখ্যাগুরু,
বললে
হবে? শ্যামাপ্রসাদ নাকি
উদার
ছিলেন,
সাম্প্রদায়িক
ছিলেন
না,
ফজলুলের
সঙ্গে
আঁতাত
তারই
প্রমান,
তথাগত
বলছেন।.........
কিন্তু
তাই
বলে
শ্যামাপ্রসাদকে
মহৎ
দেখাতে
গিয়ে
তথাগত
রায়
ফজলুলকেই
মহৎ
বানিয়ে
ছেড়েছেন।
তমাল নিশ্চয়ই আমার বইয়ের ভূমিকাটা পড়েন নি, পড়লে এই কথা লিখতেন না | আমি সেখানে খুব স্পষ্ট ভাষায় লিখেছি, শ্যামাপ্রসাদ একজন 'সেক্যুলার' (অবশ্যই প্রচলিত অর্থে) ছিলেন এমন কোনো কথা আমি প্রমাণ করার চেষ্টা করি নি, এবং এই বাবদে পলিটিকালি কারেক্ট হবারও চেষ্টা করি নি, ডিফেনসিভও নই | এই কথা বলার প্রয়োজন ছিল, কারণ আমি শ্যামাপ্রসাদ সম্বন্ধে ফজলুল হক, আবুল মানসুর আহমেদ এবং কাজী নজরুল ইসলাম-এর যে উক্তিগুলি উদধৃত করেছি তার থেকে কারুর
কারুর এমন ধারণা হতে পারে | আমার আশংকা যে অমূলক ছিল না তা তমালের লেখা পড়েই বোঝা গেল |
ফজলুল হক সাম্প্রদায়িক ছিলেন কি অসাম্প্রদায়িক সে বিষয়ে তমাল তাঁর একটি উক্তি থেকেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন ! তাঁর বাকি জীবনে তিনি যা বলেছেন বা করেছেন সেটা দেখবার কোনো দরকার নেই ? তমাল যদি আর একটু ইতিহাসচর্চা করতেন তা হলে দেখতেন, সে আমলে প্রথম শ্রেণীর মুসলিম রাজনীতিকদের মধ্যে পাঞ্জাবের স্যার সিকান্দার হায়াৎ খান ছাড়া অসাম্প্রদায়িকতার বিচারে ফজলুলের সঙ্গে আর কারুর তুলনা করা যাবে না (এখানে আমি মৌলানা আজাদ বা
খান আব্দুল গাফ্ফার খানকে ধরছি না) | দোষের মধ্যে ফজলুল দুর্বলচিত্ত ছিলেন, ক্ষমতালোভীও ছিলেন | এবং এই দুই দোষের সঙ্গে ১৯৩৭ সালের কংগ্রেসের এক হিমালয়ান ব্লান্ডার যুক্ত হয়ে বাঙালি-হিন্দুর সমূহ সর্বনাশ ডেকে এনেছিল | এর পরেও তাঁর ক্ষমতার লোভের সুযোগ নিয়ে শয়তান ইংরেজ গভর্নর হার্বার্ট তাঁকে ঘোল খাইয়েছিলেন | এই সবই আমার বইতে আছে |
আর
একটা সিরিয়াস আলোচনার মাঝখানে হঠাৎ “হুঁ হুঁ বাবা, বাংলায় মুসলমান সংখ্যাগুরু, বললে হবে?” এসব কি ছেলেমানুষি?
আর
তাদেরই
শহর
কলকাতা
তুলে
দেওয়া
হল
মাড়োয়াড়ি
ব্যবসায়ীদের
হাতে।
একে অক্ষমের আর্তনাদ ছাড়া কি বলব ? মাড়োয়ারির হাতে শহরটাকে
কে তুলে দিয়েছে ? দিয়েছে মাসের শেষে বাঁধা মাইনের মোহে বাঁধা বাঙালি-হিন্দু, ঝুঁকি নিতে না-চাওয়া বাঙালি-হিন্দু, আচার্য রায়ের ভাষায় "কঠোর পরিশ্রমে অনন্যমনা হইয়া ব্যবসা শিখিতে নারাজ " বাঙালি-হিন্দু - আবার কে ? বাঙালি-হিন্দুর হাতে তো ব্যবসা ছিল ! প্রিন্স দ্বারকানাথ, রামদুলাল সরকার, পরবর্তীকালের স্যার আর এন মুখার্জি, আলামোহন দাশ - এঁরা তো বাঙালি-হিন্দুই ছিলেন ! এই সব ব্যবসার কি হল ? বেঙ্গল কেমিক্যাল, বেঙ্গল ওয়াটারপ্রুফ, বেঙ্গল এনামেল, বেঙ্গল ইমিউনিটি, ক্যালকাটা কেমিক্যাল, ইন্ডিয়া ইলেকট্রিক - এসবের কি হল ? আমি জানি কি হল, কিন্তু এখানে লিখবার পরিসর নেই, তমাল চান তো অনুসন্ধান করে দেখুন |
বাঙালির
মধ্যে
কমিউনিস্টদের
সাফল্যের
কারন
তারা
বাংলার
বিপ্লবী
ঐতিহ্যকে
আত্মসাৎ
করতে
পেরেছে।
অংশত সত্য, পুরোপুরি নয় | কমিউনিস্টরা যখন বাংলায় কাজ
আরম্ভ করে তখন অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, শ্রী সংঘ ইত্যাদির কাজ স্তিমিত হয়ে এসেছে
| ফলে যাঁরা গীতা ছুঁয়ে শপথ নিতেন তারা উপায়ান্তর না দেখে কমিউনিস্ট হয়ে গেলেন | বিংশ
শতাব্দীর আগে যে বাঙালি-হিন্দুর মধ্যে কোনো বিপ্লব ছিল না সে কথা আগেই বলেছি | উনিশশো
ত্রিশের দশকের পরে বাঙালি-হিন্দুর রাজনৈতিক জগৎ কংগ্রেসে আচ্ছন্ন থাকলেও বৌদ্ধিক ও
সাংস্কৃতিক জগৎটা ফাঁকা ছিল - সেখানে কমিউনিস্টরা দখল নিয়ে নিল | উপরন্তু প্রাক্তন
বিপ্লবীরা অনেকেই রিফিউজি হয়ে পশ্চিমবঙ্গে এলেন এবং রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ
থেকে চরম হৃদয়হীনতা পেয়ে ক্ষোভে কমিউনিস্ট হয়ে গেলেন | সাধারণ উদ্বাস্তুদের মধ্যেও
কমিউনিস্ট পার্টি নিরলস কাজ করে নিজেদের ক্ষেত্র তৈরী করলো, কংগ্রেস তখন আখের গুছোতে
ব্যস্ত | ফল যা হবার তাই হল|
পশ্চিমবঙ্গ
আজও
যে
হিন্দুর
বাসভূমি,
তার
জন্য
শ্যামাপ্রসাদের
কিছু
অবদান
আছে,
কিন্তু
সেই
সময়ে
হিন্দুদের
মধ্যে
বাংলাভাগের
পক্ষে
এক
শরত
বসু
ছাড়া
আর
সবাই
মত
দিয়েছিলেন।
অমৃতবাজার
পত্রিকার
এক
সমীক্ষা
অনুযায়ী
প্রায়
একশো
শতাংশ
শিক্ষিত
বাঙালিই
চাইছিলেন
পশ্চিমবঙ্গ
আলাদা
থাকুক।
মুসলমান
সংখ্যাগুরুত্বের
গুরুভার
নিয়ে
বাঁচা
সম্ভব
নয়
সেটা
সবাই
বুঝতে
পারছিলেন।
কাজেই
এটা
অতিশয়োক্তি
যে
একা
হাতে
শ্যামাপ্রসাদ
বাংলার
হিন্দুর
বাসভূমি
গড়ে
দিয়ে
গেছেন,
এবং
এই
অতিশয়োক্তির
ওপরে
শ্যামাপ্রসাদের
মূল্যায়ন
দাঁড়
করালে
তাঁর
প্রতি
অবিচারই
করা
হবে,
কারণ
সেই
মূল্যায়ন
শক্তপোক্ত
হবে
না।
তথ্যগতভাবে ঠিক নয় - কিরণশঙ্কর রায়ও কিছুদিনের জন্য স্বাধীন সার্বভৌম অখণ্ড বাংলা তৈরির পক্ষে ছিলেন | যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, তফসিলি ফেডারেশন-এর নেতা তো চাইছিলেন গোটা বাংলাই পাকিস্তানে যাক | অপরপক্ষে শ্যামাপ্রসাদ বাংলা ভাগ করার জন্য ১৯৪৭ সালের মার্চ মাস থেকে চেষ্টা আরম্ভ করেছিলেন | অমৃতবাজার পত্রিকার যে-সমীক্ষা সম্বন্ধে তমাল লিখেছেন সেটা আপনা-আপনি হয় নি, শ্যামাপ্রসাদের প্রচেষ্টারই ফসল |
তথ্যগতভাবে ঠিক নয় - কিরণশঙ্কর রায়ও কিছুদিনের জন্য স্বাধীন সার্বভৌম অখণ্ড বাংলা তৈরির পক্ষে ছিলেন | যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, তফসিলি ফেডারেশন-এর নেতা তো চাইছিলেন গোটা বাংলাই পাকিস্তানে যাক | অপরপক্ষে শ্যামাপ্রসাদ বাংলা ভাগ করার জন্য ১৯৪৭ সালের মার্চ মাস থেকে চেষ্টা আরম্ভ করেছিলেন | অমৃতবাজার পত্রিকার যে-সমীক্ষা সম্বন্ধে তমাল লিখেছেন সেটা আপনা-আপনি হয় নি, শ্যামাপ্রসাদের প্রচেষ্টারই ফসল |
শরৎ বসু-আবুল হাশিম-ফ্রেডেরিক বারোজ ত্রয়ী স্বাধীন সার্বভৌম
অখণ্ড বাংলা তৈরির যে অপচেষ্টা চালাচ্ছিলেন, যার পিছনে চালিকা শক্তি ছিলেন জিন্না-লিয়াকত-সোহরাওয়ার্দি
এবং তা নিয়ে মাউন্টব্যাটেন-এর কাছে দরবার-ও করেছিলেন তা ব্যর্থ করতে একমাত্র শ্যামাপ্রসাদই
পারতেন এবং তিনি তা করেওছিলেন | আর এক বিচিত্র যুক্তি - সবাই বাংলা ভাগ চাইছিলেন |
চাইছিলেন বলেই বাংলা ভাগ হয়ে যেত? নেতৃত্বের দরকার ছিল না? অবশ্যই ছিল এবং সেই নেতৃত্ব
একমাত্র শ্যামাপ্রসাদই দিতে পেরেছিলেন - একথা কংগ্রেস নেতারাও বুঝেছিলেন বলে তাঁরা
এই ব্যাপারে শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্ব মেনেও নিয়েছিলেন | অতএব একা হাতে শ্যামাপ্রসাদ বাংলার হিন্দুর বাসভূমি গড়ে দিয়ে গেছেন, এটা আদৌ অতিশয়োক্তি নয়, এটাই
বাস্তব|